কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে নৃশংস জঙ্গি হামলা, তাতে বহু মানুষের মৃত্যু - এই সমস্ত খবরই ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিল সুব্রত ঘোষের কাছে। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তখন থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, হিসাব অনুসারে - হামলার সময় পহেলগাঁওয়েই থাকার একটা সম্ভাবনা ছিল সুব্রতর দিদি শবরী, জামাইবাবু সমীর, এবং ভাগ্নী শুভাঙ্গীর। তাঁরা কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন গত ১৬ এপ্রিল। ফেরার কথা ছিল ২৩ এপ্রিল।
সুব্রত অনেক চেষ্টা করেও দিদি-জামাইবাবু বা ভাগ্নীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। শেষে খবর আসে... সেই খবর ছিল ভয়ঙ্কর! তখন ভোররাত (বুধবার - ২৩ এপ্রিল, ২০২৫), প্রায় তিনটে বাজে। হঠাৎ বেজে উঠল সুব্রতর মোবাইল। সুব্রত মোবাইল কানে তুলতেই জানতে পারলেন, অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির নাম ও পরিচয়। তিনি একজন সাধারণ কাশ্মীরি - পেশায় গাড়িচালক, নাম ইকবাল।
সুব্রতর জামাইবাবু সমীর গুহ নিজেই স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কাশ্মীর ঘোরার সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলেন। ভূস্বর্গে পৌঁছনোর পর একটি গাড়ি ভাড়া করে ঘুরছিলেন তাঁরা। সেই গাড়ির চালকের নামই ইকবাল। তিনিই ভোররাতে সুব্রতর মোবাইলে ফোন করে সেই দুঃসংবাদটি দেন, যা সুব্রতর পরিবার মোটেও শুনতে চায়নি।
ইকবাল জানান, জঙ্গিদের নিশানায় শেষ হয়ে গিয়েছেন সমীর। তবে, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের কোনও শারীরিক ক্ষতি হয়নি। এরপর সুব্রত তাঁর দিদি শবরীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। মোবাইল কানে নিয়ে সমানে কেঁদে যাচ্ছিলেন।
সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য বলছে, এই ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়বহতা শবরী ও শুভাঙ্গীকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল মুহূর্তে। তাঁদের উপর দিয়ে যে ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তা অনুভব করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি কাশ্মীরি গাড়িচালক ইকবালের। তিনি অন্য কারও উপর ভরসা না করে শবরী ও শুভাঙ্গীকে সঙ্গে করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। সাধ্য মতো চেষ্টা করেন যাতে মা ও মেয়েকে যতটা সম্ভব এই ট্রমা থেকে বের হতে সাহায্য করা যায়।
সমীর গুহ কলকাতার বেহালার জগৎ চৌধুরী রোডের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা-মা আগেই গত হয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের জুনিয়র স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসার পদে কর্মরত। স্ত্রী ও কন্য়াকে নিয়ে 'সুখের সংসার' ছিল। সমীরের এক দাদাও রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তিনি থাকেন ছত্তিশগড়ে।
সমীরের মেয়ে শুভাঙ্গী আইসিএসই বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। সদ্য পরীক্ষা হয়েছে তার। বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে শুভাঙ্গী। বেহালার বাড়িতে এখনও সাজানো রয়েছে - বাবা-মেয়ের ছবি। সেটা তোলা হয়েছিল গতবছর ফাদার্স ডে-র দিন।
সমীরের এক প্রতিবেশী অর্চনা গজেন্দ্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বুধবার সকালে তাঁর সঙ্গে সমীরের স্ত্রী ও মেয়ের কথা হয়েছে। শবরী এই ঘটনার ধাক্কা কিছুতেই সামলাতে পারছেন না। শুভাঙ্গী অর্চনাকে জানিয়েছে, মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২০২৫) দুপুরে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বাকি পর্যটকদের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ দূর থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখোশধারী জঙ্গিরা পর্যটকদের ঘিরে ধরে। সকলকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে। পর্যটকরা সেটাই করেন। এরপরই শুরু হয় 'নিধন যজ্ঞ'! জঙ্গিরা বেছে বেছে, সমীর ও আরও কয়েকজনকে গুলি করে খুন করে! মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যায়।